মিফতার ধাক্কা

 ঢাকা বিমান বন্দরে পা দিতেই মনটা আনন্দে ভরে উঠল মিফতার। প্রায় দুই বছর পর বাংলাদেশে আসলো সে। প্রাইভেট ভার্সিটিতে বাবা মার বকুনি খেয়ে বিবিএ শেষ করে অস্ট্রেলিয়া চলে যায় মিফতা। প্রিয়াঙ্কাকে কথা দিয়েছিল সে তার এমবিএ শেষ করে ভালো একটা চাকরিতে যোগদান করে দেশে ফিরবে। সব এখন কমপ্লিট, আপাতত প্রিয়াঙ্কাকে বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা এখন।কি কান্নাই না কেঁদেছিল মেয়েটা ,মিফতা চলে যাবার সময়। এমনই বলে মনে হয় মিফতার। কিন্তু আসলে শুধু টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ মোছা ছাড়া কিছুই করেনি। যেমনটা আশা করেছিল ঠিক তাই ঘটল।তাকে নিতে আসার জন্য বাড়ি থেকে কেও আসেনি। প্রিয়াঙ্কাকে অবশ্য একটা সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য কিছু বলেনি। হাতে ঠেলাগাড়ি টানার মত একটা ট্রাভেল ব্যাগ আর কাধে ব্যাগ নিয়ে একটা সিএনজির সামনে গিয়ে সেই পুরনো দিনের মত বলল, ‘মামা, যাবেন?’ খুব অনিচ্ছায় আর বিরক্ত হয়ে সিএনজি চালক জিজ্ঞেস করল, ‘কই?’ ‘গুলশান-২।’ কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘৮০০ ট্যাকা লাগবো।’ বলে কি এই ব্যাটা! এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েছে বলে এত চাবে নাকি। কিছু না বলে মিফতা ওর গাঁটটি-বোচকা নিয়ে হাটা ধরে। তবে ৫০০ টাকার নিচে সে যেতে পারলো না। মুখ ভাড় করে সিএনজিতে উঠার পর আবারও ঢাকা শহর দেখতে পেয়ে মনটা কিছুটা হালকা হল। গুলশানে ঢুকতে প্রথমে পরে প্রিয়াঙ্কাদের বাড়ি। মিফতার মনে হল এখনই সে ঢুকে পড়বে। তারপর আবার নিজেকে সামলে নিল।
 #কলিংবেল দিতেই বুয়া এসে দরজা খুলে দিয়ে চলে গেল। মিফতা ওর ঘরে ঢুকতেই পিছনে পিছনে ছোট ভাইটা এল। ‘ভাইয়া, চকলেট এনেছ?’ ‘জি না, ভাগ এখান থেকে।’  ঝারি শুনে ভেগে যায় ছেলেটা। ফ্রেশ হওয়ার আগে একবার বাবা-মার ঘরে যায় মিফতা। বাবা ঘরে বসে একটা খবরের কাগজ পড়ছিলেন।‘বাবা,ভাল আছ?’ খবরের কাগজ থেকে মুখ সরিয়ে একবার মিফতার তাকান ভদ্রলোক। পেশায় তিনি একজন রিটায়ার্ড ম্যাজিস্ট্রেট। জীবনে তার অর্জন বলতে গেলে গুলশানের মত জায়গাতে বাড়ি বানানো। ‘আছি ভাল’ মুখ গম্ভির করে বললেন তিনি, ‘তোর খবর কি?’ ‘এইতো এখনই আসলাম।’ ‘আচ্ছা।’ এই বলে আবারও খবরের কাগজে মনোযোগ দেন মিফতার বাবা। মিফতা কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে যায় রান্নাঘরে। রান্নাঘরে মা নিজেই রান্না করছিলেন আর বুয়া তাকে সাহায্য করছিল। ‘মা,কি রান্না করছ?’ তার আসা উপলক্ষে স্পেশাল কিছু তৈরি করলেও করতে পারে ভেবে জিজ্ঞেস করে মিফতা। ‘কিছু না তেমন। তোর বাবা আজকে বাজার করেনি। ঘরে যা ছিল তাই রান্না করছি।’ ‘খুবই ভালো।’ এই বলে ঘরে চলে যায় মিফতা। তার বাড়ির লোকজন মনে হয় এই জীবনে পরিবর্তন হবে না।
#বিকেল বেলা পাড়ার বন্ধু্দের সাথে দেখা করার আগে প্রিয়াঙ্কাদের বাসায় চলে যায় মিফতা। প্রিয়াঙ্কাদের ফ্লাটে তালা ঝুলছে। তার মানে ও ছাদে। সেখানে যেতেই প্রিয়াঙ্কাকে দেখতে পায় মিফতা। ‘প্রিয়াঙ্কা।’ প্রিয়াঙ্কা ঘুরে তাকায় মিফতার দিকে। ‘আমি ফিরে এসেছি।’ প্রিয়াঙ্কাকে দেখে মনে হল না যে সে খুশি হয়েছে। ‘তো কি হয়েছে? আমি আর তোমার নাই।’ মিফতার মনে হল হঠাৎ কোথা থেকে যেন তার মাথায় ঠাডা পড়ল। ‘মানে কি! এসব তুমি কি বলছ?’ ‘তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে, ভুলে গেছো?’ ‘হ্যাঁ, কিন্তু সেটা এক বছরের জন্য মাত্র।’ ‘তারপর তুমি সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলে।’ ‘বুঝতে চেষ্টা কর। আমি ক্লাস করে সারাদিন দুই তিনটা পার্ট টাইম জব করে আর এনার্জি পেতাম না।’ ‘কি বুঝব। সব কিছুর টাইম হত অথচ আমার জন্য হত না। সেজন্য এতদিনে আমার সাথে একদিনও তোমার কথা বলার সময় হয়নি?’ ‘আচ্ছা ভুল হয়ে গেছে,সরি। আর এরকম হবে না।’ ‘তার আর দরকার হবে না। আমি এখন একটা নতু্ন রিলেশনে আছি।’ ‘কি!’ আৎকে উঠে মিফতা। ‘আমি যেতে না যেতেই তুমি আরেকটা রিলেশন করে ফেলেছ?’ ‘হ্যাঁ, তুমি আমাকে আর জ্বালাবে না। এখানে থাকলে থাকো। আমি গেলাম।’ প্রিয়াঙ্কা চলে যেতেই মিফতার কেমন জানি লাগে। পরীক্ষায় ফেল হবে জেনেও রেজাল্টে ফেল দেখলে যেমন লাগে অনেকটা সেরকম লাগছে। হা করে কিছুক্ষণ সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব বিমর্ষও লাগছে না, কষ্টও লাগছে না। আবার আনন্দও লাগছে না। কেমন যে লাগছে মিফতা নিজেই বুঝতে পারে না। অন্য কোন ছেলে তার জায়গায় হলে নিশ্চয় মদ-গাঁজা ধরবে। কিন্তু মিফতা তা করবে না। কারন সে এগুলা আগে থেকেই খায় মাঝে মধ্যে। তবে এলাকার কেও কখনো চিন্তাও করতে পারে না এই কথা। নাহ, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। কিছু একটা করা দরকার। অভিভাবকদের তার সমন্ধে যাই ধারনা থাকুক না কেন এবার সে কিছু একটা করবে।  # মিফতার কাছে থেকে সরে এসেই প্রিয়াঙ্কা রনিকে ফোন দেয়। আধা ঘণ্টার মধ্যে রনিকে গুলশানের একটা রেস্টুরেন্টে চলে আসতে বলে। নিজেও তৈরি হয়ে নেয় দশ মিনিটের মধ্যে। জীবনে প্রথম এত তাড়াতাড়ি সে তৈরি হল। নিজের এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়েই একটা রিক্সা ঠিক করে ফেলে। রিক্সায়ালাকে বারবার তাড়া দিলে একটু বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলে না। রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই রনিকে দেখতে পায় প্রিয়াঙ্কা। প্রিয়াঙ্কাকে দেখে রনি দাঁড়িয়ে পড়ে। ‘কিছু হয়েছে নাকি ,বেবি? হঠাৎ এভাবে ডাক দিলে যে। সব ঠিক আছে তো?’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়াঙ্কা, ‘নাহ, সব ঠিক নাই। মিফতা ফিরে এসেছে।’ রনির চোখ বড় বড় হয়ে যায়, ‘তাই নাকি? ও কি তোমাকে ফিরে আসার জন্য কনভিন্স করেছে?’ ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি না বলে দিয়েছি।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রনি। ‘আমি জানতাম তুমি তাই করবে। আর আমি এটাও জানি তুমি একমাত্র আমাকেই বিয়ে করবে।’ ‘অবশ্যই রনি। আমি তোমাকে ছাড়া আর কাওকে বিয়ে করব না।’ রনির মাথায় চট করে তখন একটা চিন্তা আসে। আর যাই হোক প্রিয়াঙ্কার মত সুন্দরি মেয়েকে হাতছারা তো কোনভাবেই করা যাবে না। ‘তাহলে আমারা আমাদের বাবা-মাকে বিয়ের কথা বলি।’ ‘মাথা খারাপ তোমার! আমাদের পড়ালেখাই তো শেষ হয়নি। আমার বাবা যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করে তুমি কি কর তখন তুমি কি জবাব দেবে?’ প্রিয়াঙ্কার কথা শুনে রনি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। ‘আমাকে কিছুই বলতে হবে না। তুমি শুধু তোমার বাবাকে বলবে আমার বাবা পাঁচটা ইন্ডাস্ট্রির মালিক। আর তার ঢাকা শহরে তিনটি, কক্সবাজারে একটি হোটেল আছে। আমার কোন জবের দরকার নাই।’ একটু ইতস্তত করে বলে, ‘মনে হয় এত সোজা হবে না।’ ‘তুমি খালি বলে দেখ।’ ‘আচ্ছা, ঠিক আছে আমি বলে দেখব। এবার কিছু খাবার অর্ডার কর।’ রনি এবার ওয়েটারকে ডাক দেয়। কিছু খাবার অর্ডার করে দুজনে মিলে সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।  # সোহানকে লাথি মারতেই ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে। ‘এই হারামজাদা, কয়টা বাজে? এখনও যে ঘুমাচ্ছিস?’ মিফতাকে দেখে চোখ কচলাতে কচলাতে একটা ফিক করে হাসি দিয়ে বলে, ‘ভাই যে! কবে আইলেন?’ ‘আজকেই এসেছি। আমাকে কিছু জানানো হয়নি কেন শুনি।’ কেলিয়ে কেলিয়ে হাসতে হাসতে সোহান বলে, ‘প্রিয়াঙ্কা আপুর কথা বলতাছেন, তাই না? ভাবছিলাম আপনারে যদি জানাই তাহলে সব ফালাইয়া লাফ মাইরা চইলা আসেন।’ কটমট করে মিফতা তাকিয়ে থাকলে হাসি বন্ধ করে সোহান। ‘প্রিয়াঙ্কা কার সাথে প্রেম করছে বল তো।’ একটা ঢোঁক গিলে কথা বলা শুরু করে সোহান, ‘পোলার নাম হইল রনি। বিশাল কোটিপতির ব্যাটা। আপুর লগেই পড়ে। একটা মার্সিডিজ নিয়া নিজেই ড্রাইভ কইরা ভার্সিটি যায়।’ ‘তার মানে সমবয়সী।’মিফতা  এবার সোহানের আর একটু কাছে আসে, ‘শোন, তোকে একটা কাজ করতে হবে।পারবি না?’ ‘কি কাম, আগে কন।’ ‘প্রিয়াঙ্কা কখন কোথায় যাচ্ছে সব আমাকে সাথে সাথে জানাবি।’ আবারও দাঁত বের করে হাসে সোহান।‘এইডা আর এমন কি কাম। আমার সব চ্যালা চামুণ্ডারে কাজে লাগায় দিতেছি। আর আপনার নাম্বারটাও দিয়া দিমু। লগে লগে জানাইবো।’  ‘ঠিক আছে তাইলে কাজে লেগে পড় তাইলে।’ আবারও ঢোঁক গিলে সোহান, ‘ভাই কিছু টাকা যে লাগত।’ ‘গাঁজা খাবি, তাই না?’ ফিক করে হেসে দিয়ে সোহান বলে, ‘ইরিইইইই ভাই, অ্যামনে কইতে হয় নাকি। হে হে। আপনারেও এক কার্তুজ দিমুনে।’ ‘আমার লাগবে না। তুই কাজটা ঠিকমত কর।’ ‘আপনে খালি দেহেন আমি কি করি।’ মিফতা এবার চলে যেতে নেয়। আবারও একটা ব্যাপার মাথায় আসে, ‘আর একটা কাজ করবি। ওই রনির বাপের সমন্ধে খোঁজ নিবি।’ উৎসুক চোখে সোহান তাকায়, ‘বাপ কেন,ভাই?’ ‘বুঝবি না’ এই বলে চলে যায় মিফতা। এখন আপাতত কাজ নেই মিফতার। পুরনো বন্ধুগুলোর খোঁজ নেয়া যেতে পারে এখন।
# রাত প্রায় নয়টা বাজে। প্রিয়াঙ্কা এখনও বাড়ি ফেরেনি। সামশুল সাহেব অবশ্য চিন্তায় অস্থির নন। প্রায়ই এরকম করে মেয়েটা। তবে সামশুল সাহেব তার মেয়ের উপর রুষ্ট নন। তার কাছে মনে হয় তার মেয়ে খুবই ভালো, সব কথাই শুনে শুধু মাঝে মধ্যে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি করে। প্রকৃতপক্ষে প্রিয়াঙ্কার জন্মের সময় ওর মা মারা যায়। সামশুল সাহেব নিজে সুদর্শন থাকলেও তার স্ত্রী মোটেই সেরকম ছিলোনা। টাকা পয়সাই বলতে গেলে তিনি বিয়ে করেছিলেন। আর সাথে স্ত্রী ছিল ফ্রি। স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে সামশুল সাহেব প্রথমে নিজের সন্তানকে দেখতে চান। নার্স যখন তার কোলে একটি সাদা ফুটফুটে বাচ্চা দেয় তখন তার মনটা আনন্দে ভরে উঠে। যাক মেয়েটা তাহলে তার মায়ের দিকে যায়নি আর স্ত্রীর হাত থেকেও মুক্তি পাওয়া গেল। এরপর আর বিয়ে করেননি তিনি। অনেক আদরে বড় করেন প্রিয়াঙ্কাকে। যার ফলে আজ তার মেয়ে বাঁদরে পরিণত হয়েছে। একটু পরে প্রিয়াঙ্কা ফিরে আসে। ঢুকতেই সে বলে, ‘বাবা, তোমার সাথে আমার কথা আছে।’ হাসিমুখে সামশুল সাহেব বলেন, ‘হা,মামুনি বল।’ ‘বাবা, আমি আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চাই।’ ‘ওহ,হ্যাঁ। শুনলাম মিফতা নাকি বাংলাদেশে ফিরে এসেছে।’ প্রিয়াঙ্কা এক সেকেন্ড দম নিয়ে নেয়।তারপর এক নিঃশ্বাসে বলে, ‘আমি মিফতার কথা বলছি না বাবা। আমার নতুন একটা রিলেশন হয়েছে।’ মেয়ের কথা শুনে সামশুল সাহেব আঁতকে উঠেন, ‘কি! কিন্তু কেন? মিফতা তো ভালো ছেলে। ওর সমস্যা কি?’ ‘ও অস্ট্রেলিয়াতে চলে যাবার পর আমার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিইয়েছিল। সামশুল সাহেব এবার বুঝতে পারেন ব্যাপারটা। মেয়েকে অনেক আদরে বড় করেছেন তাই কারো কাছে থেকে মন মত ব্যবহার না পেলেই রাগ করে বসে। মেয়েকে বোঝানোর তাই চেষ্টা করেন, ‘আসলে অস্ট্রেলিয়াতে জীবন অনেক কঠিন। আর তুমি যে ছেলের কথা বলছ সে কি করে?’ ‘ও আমার ক্লাসমেট।’ ‘কি!’ আবার আঁতকে উঠেন সামশুল সাহেব। ‘মাথা ঠিক আছে তোমার? বিয়ে করে চলবে কিভাবে?’ প্রিয়াঙ্কা এবার এক নিঃশ্বাসে রনির শেখানো কথাগুলো বলে, ‘ওর নাম রনি। ওর বাবা পাঁচটা ইন্ডাস্ট্রির মালিক। আর ঢাকায় তার তিনটা এবং কক্সবাজারে একটা হোটেল আছে। ওর বাবা বেশিরভাগ সময়ই বিদেশে থাকেন। রনিই পড়ালেখার পাশাপাশি এগুলোর দেখাশুনা করে। এতক্ষণে সামশুল সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। যাক, মেয়ের তাহলে বুদ্ধি হয়েছে। জীবনে যে টাকার কত দরকার তা বুঝতে শিখেছে। তারপরও সে বলে, ‘কিন্তু মিফতা ছেলেটা ভালো ছিল বলে মনে হয় আমার।’ ‘কিন্তু আমারা ওকে যেমন ভাবতাম ও তা নয়।’ ‘ঠিক আছে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন প্রিয়াঙ্কার বাবা। ‘আমারা অনেক সময় অনেক মানুষকেই অন্য রকম ভাবি।এই রকম অভিজ্ঞতা আমারও আছে। আমি তাহলে রনির মায়ের সাথে কথা বলব।’ প্রিয়াঙ্কার মুখে এবার হাসি দেখা যায়, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, বাবা।’ ‘ঠিক আছে মামুনি। আমি চাই তুমি যেন খুশি থাকো।’
# বাড়ি ফিরেই রনি প্রথমে মার ঘরে চলে যায়। তার মা বরাবরের মতই মূর্তির মত বসে থেকে হিন্দি সিরিয়াল দেখছিলেন। সোজাসোজি কথায় চলে আসে রনি। ‘মা,আমি বিয়ে করব।’ টিভির সামনে থেকে চোখ না সরিয়ে জাহানারা খাতুন শুধু বললেন, ‘তোমার পড়ালেখা শেষ হয়নি।’ ‘তো কি হয়েছে? আমি খুব একা অনুভব করি। সারাদিন শুধু আমি ভার্সিটি আর বাবার অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকি। দিন শেষে আমি কারো সাথে বলতে চাই।’ ‘সারা রাত তো অনেক মেয়ের সাথেই কথা বল। তাও হয় না। আর বিয়ে করলে কোনটাকে করবা?’ ‘মা,আমি সিরিয়াস।’ রোবটের মত আবারও জাহানারা খাতুন শুধু বলেন, ‘আমি তাহলে তোমার ঐ মেয়ের সাথে দেখা করব।’ ‘থ্যাংকস,মা।’ রনি চলে গেলে তার মা একটু ঘার ঘুরিয়ে দেখেন। নাহ, ছেলে চলে গেছে। আবারও সিরিয়ালে মনোযোগ দেন তিনি।
 #-হ্যালো। -হ্যাঁ, ভাই। আমি সোহানের বন্ধু ,জিকো বলছি। _হ্যাঁ, বল। _আপনি রনির বাবার কথা জানতে চেয়েছিলেন শুনলাম। – হ্যাঁ,দরকার ছিল। -ওনার নাম হল রকিবুল হাসান। বিশাল বড় কোটিপতি। গ্যারেজে তিন চারটা গাড়ি আছে। তার মধ্যে……… -ওনার চরিত্র সমন্ধে বল। -খুব ভালো বলে কেউ জানে না। বেশিরভাগ কোটিপতির মত তিনিও মদ্যপান করেন। তবে একটু বেশি। বিদেশেই পড়ে থাকেন সাধারণত। ঢাকার নাইট ক্লাবে প্রায়ই দেখা যায়। -যথেষ্ট। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। -ভাই, বলছিলাম কিছু… -ওটা সোহানকে দিয়ে দিব। -আচ্ছা ভাই,ঠিক আছে।  #আধা ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছে প্রিয়াঙ্কা আর ওর বাবা হোটেলে বসে আছে। রনির পাত্তাও নেই। রনি হয়তবা ওর মার সাথে আছে তাই ফোন দিতে সাহস পাচ্ছিল না প্রিয়াঙ্কা। যতবারই হোটেলের দরজা খোলা হচ্ছে ততবারই প্রিয়াঙ্কা সেদিকে তাকাচ্ছে। এক সময় রনি আর ওর মা প্রবেশ করলে প্রিয়াঙ্কা খুশিতে দাঁড়িয়ে যায়। প্রিয়াঙ্কার বাবাও দাঁড়িয়ে যায় কিন্তু রনির মাকে দেখে তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। রনির মারও একই অবস্থা হয় প্রিয়াঙ্কার বাবাকে দেখে। ‘রনি,এই যে আমার বাবা।’ ‘আর ইনি আমার মা।’ ‘তুমি!’ থতমত খেয়ে প্রিয়াঙ্কার বাবা বলে উঠেন।রনির মাও ঠিক একইভাবে বলেন, ‘তুমি!’ রনি হাসতে হাসতে বলে,‘বাহ,আপনারা পরিচিত তাহলে।’ ‘খুব ভালো করে।’ অনেকটা খোঁচা মারার ইঙ্গিতে বলেন প্রিয়াঙ্কার বাবা।রনি এই প্রথম দেখতে পায় তার মা রোবটের মত কথা না বলে স্বাভাবিকভাবে বলছেন, ‘আমি জানতাম না তুমি এখনও বেঁচে আছো।’ ‘আমি কখন বলেছি যে তোমাকে ছাড়া আমি মারা যাব।’ গজরাতে গজরাতে বলেন সামশুল সাহেব। ‘হচ্ছেটা কি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’ প্রিয়াঙ্কা রনির দিকে তাকায় একবার। ‘এই বিয়ে হবে না।’ বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা দেন সামশুল সাহেব। রনি আকাশ থেকে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে, ‘কেন! কি হল!’ ‘ঠিকই বলেছেন উনি। রনি, এসো আমার সাথে।’ রনিকে টানতে টানতে নিয়ে যান জাহানারা খাতুন। ‘প্রিয়াঙ্কা,এসো আমার সাথে।’ প্রিয়াঙ্কাকেও একইভাবে নিয়ে যান সামশুল সাহেব। এপাশ থেকে রনি একবার বলে, ‘কিন্তু আঙ্কেল………’ আর ওপাশ থেকে প্রিয়াঙ্কা একবার, ‘কিন্তু আনটি……’
# -ভাই, আসসালামু আলাইকুম। আমি সোহানের বন্ধু ,রাকিব বলছি। -ওয়ালাই কুমুস সালাম। কি খবর বল। -আজকে আমার হোটেলে রনি-প্রিয়াঙ্কা আর তাদের বাবা মা এসেছিল। -তোমার হোটেল মানে? -মানে, আমি যে হোটেলের ওয়েটার আর কি। -ও,আচ্ছা। তারপর? -প্রিয়াঙ্কার বাবা আর রনির মা তো প্রায় ঝাপিয়ে পড়েন একে অন্যের উপর। -কোন কথা শুনেছ? -একবার শুনলাম প্রিয়াঙ্কার বাবা বলে উঠলেন তোমাকে ছাড়া আমি মরব কেন এই টাইপের একটা কথা বলে উঠলেন। -অনেক ধন্যবাদ তোমাকে ,রাকিব। খুব ভালো খবর শোনালে। -আর ভাই, আমাকে যদি ইয়ে আর কি… -ওটা সোহানের কাছে থেকে নিয়ে যেও। -আচ্ছা,ভাই। ঠিক আছে। ফোন নিয়ে ভাবে কিছুক্ষণ মিফতা। তারপর সোহানকে কল করে। -হ্যালো,সোহান? -জি, ভাই বলেন। -কালকে প্রিয়াঙ্কা যখনই বাড়ি থেকে বের হবে সাথে সাথে আমাকে জানাবি। _আচ্ছা, ভাই ঠিক আছে। আর ভাই বলছিলাম রাকিব আর…… _ওটা নিয়ে যাস। -আর ভাই, আমারটা। _ওটাও নিয়ে যাস, হারামজাদা। -আচ্ছা,ভাই ঠিক আছে।
#খুব বেশি সকাল হয়নি। বড়জোর সকাল সাড়ে নয়টা। প্রিয়াঙ্কা আর রনি দুইজন দুজনের হাত ধরে বসে আছে। পার্কে আর লোকজন নেই। সবাই মোটামুটি মর্নিং ওয়াক করে বাড়ি ফিরে গিয়েছে। সোহানের ফোন পেয়েই মিফতা প্রিয়াঙ্কার পিছু পিছু চলে এসেছে। প্রিয়াঙ্কা খেয়ালও করেনি।আস্তে আস্তে মিফতা ওদের পিছনে চলে আসে। ‘এখন আমরা কি করব,রনি?’ জিজ্ঞেস করে প্রিয়াঙ্কা। রনি কিছু বলে না। চুপচাপ বসে থাকে ওরা দুজন। নাহ,নিরবতা ভাঙ্গা দরকার। ‘হ্যাল্লো।’ মিফতার গলা শুনে চমকে উঠে ওরা দুইজন। ‘তুমি এখানে কি করছ? আর আমাদের পেলে কিভাবে?’ প্রশ্ন করে প্রিয়াঙ্কা। রনি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে শুধু। ‘শুনলাম তোমাদের বাবা-মা নাকি পল্টি মেরেছে।’ দাঁত বের করে জিজ্ঞেস করে মিফতা। রনি জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি জানলে কিভাবে?’ মিফতা সব জান্তার মত বলে, ‘আমার সব জায়গায় চোখ আছে।’ রনি শুধু বলে, ‘প্লিজ, আমাদেরকে একা থাকতে দাও।’ ‘কিন্তু আমি তো তোমাদেরকে সাহায্য করতে চাই।’ প্রিয়াঙ্কার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মিফতা আজ পর্যন্ত যা চেয়েছে তাই করেছে। কিন্তু একটু খটকা লাগে। তাই জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু তুমি আমাদের সাহায্য করতে চাও কেন?’ ‘আমি চাই তুমি সুখে থাক। আর কিছু না।’ ‘ওহ,মিফতা তুমি কত সুইট। ‘কিন্তু তুমি কিভাবে কি করবে?’ আবারও রনি জিজ্ঞেস করে। ‘ওটা তোমরা আমার উপর ছেড়ে দাও।’ মিফতা আরও কিছু কথা বলে হাঁটা ধরে। প্রিয়াঙ্কা আর রনি চুপচাপ বসে থাকে।  #’আরে মিফতা যে। এসো এসো। ‘সামশুল সাহেব হঠাৎ মিফতার আগমনের কারন বুঝতেপারেননা। মিফতাকে বসতে বলে নিজেও বসেন তার সামনে। -তাহলে,বাবা।কেমনআছো? -এইতোআঙ্কেল।ভালইআছি।শুনলামপ্রিয়াঙ্কাকে নাকি ওর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছেননা। -অনেক বড় কাহিনী, মিফতা। -আমার সময় আছে আঙ্কেল। -কি আর বলব তোমাকে? আমি নিজেই বুঝতে পারছিনা। -আপনার সাথে রনির আম্মুর সম্পর্ক ছিল, তাইনা? -ঠিক ধরেছ, তুমি। ও আমার সাথে প্রতারণা করেছিল। ধনী ছেলে পাওয়ার পর আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তারপর থেকেই আমি টাকার পিছনে ঘোরা শুরু করি। -বুঝলাম,আঙ্কেল।কিন্তু আপনারতো নিজের মেয়ের কথা একবার চিন্তা করা উচিত। -না,একদম না।আমিওর ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে একদমই দিবনা। -হতেপারে আনটির ওই সময়ে কোন কারন ছিল। -কিরকম? -পারিবারিকচাপ,চারপাশের সমাজের চাপ। এখন একটা মেয়ের পক্ষে লাভ ম্যারেজ যত সহজ তখনতো আরতা ছিল না। -হমম।হতেপারে।কিন্তু তোমারতো খুশি হওয়া উচিত।তুমি প্রিয়াঙ্কার কাছে এখন যাচ্ছনা কেন? -নাহ, আঙ্কেল সবসময় নিজের কথা চিন্তা করলে হয়না। কখনও কখনও আমাদেরকে কাছের মানুষের খুশির কথা ভাবতে হয়। -তোমার চিন্তা সব সময় অন্য রকম। তুমি আসলেই একটা ভাল ছেলে। কিন্তু আমি রাজি হলেও জাহানারা কি রাজি হবে? -আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি। -কিভাবে? -সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন। -তোমার উপর আমার আস্থা আছে আমার। -ধন্যবাদ।আমিএখনউঠি। -সকালের নাস্তা করে যাও। -অন্য আরেকদিন, আঙ্কেল। -আচ্ছা, ঠিক আছে।দেখা হবেআবার।
 # রনির বাড়ির সামনে মিফতা এখন দাঁড়িয়ে। প্রকাণ্ড বড় দরজা দেখে ঢুকতে একটু ভয় করছে। গ্যারেজে অনেকগুলো গাড়ি পার্ক করা আছে। মার্সিডিজ, বি.এম.ডাব্লিউ, পোরশে কি নেই। দম নিয়ে ভিতরেপা দেয় মিফতা। সাথে সাথে দারোয়ান খপ করে ধরে। ‘কোন ফ্ল্যাটে যাবেন?’ ‘এই তো রনিদের ফ্ল্যাটে।’  ‘থামেন ফোন দেই। আপনার নাম বলেন।’ ‘থামেন,থামেন,থামেন।’ চট করে মিফতা থামায় দারোয়ানকে। ‘রনি বলেছে আমি কল দিলেও আস্তে করে দরজা খুলে দিবে।সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় দারোয়ান, ‘কেন!’ ‘মানে বুঝেনইতো, বন্ধুরা মিলে আরকি।হেহে।’ ‘নাহ, ভাই এভাবে যেতে দেয়া যাবেনা।’  উপায় না দেখে মিফতা এবার মানিব্যাগে হাত লাগায়।  ‘ওহ,হ্যাঁ। রনি আপনার জন্য কিছু টাকাও দিয়েছে। দুশো টাকা বের করে দেয় দারোয়ানের হাতে । টাকা হাতে নিয়ে দারোয়ান কিছুক্ষন ভাবে তারপর বলে, ‘আর দুশো দেন।’ ‘কিন্তু রনিতো এটাই দিয়েছে। ‘তাইলে ভাই পারবো না।’ অগত্যা মিফতা আরো দুশো টাকা বের করে দেয়। রনির ফ্ল্যাটের বাইরে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজায় মিফতা। দরজা জাহানারা আনটি খুলে দিলে হকচকিয়ে যায়। বাড়ির কাজের মানুষগুলো কই ভাবে মিফতা। মুখে বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম ,আনটি।’ সালামের উত্তর না দিয়ে কঠিন স্বরে রনির মা জিজ্ঞেস করেন, ‘কে তুমি?’ ‘আমি আনটি রনির বন্ধু।’ ‘কোন বন্ধু?’ আরও কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করেন জাহানারা খাতুন। ‘জি, আনটি, মিফতা।’ ‘কেমন বন্ধু হও তোমরা?’  ‘আমরা একই সাথে পড়ি।’ রনির মা এইবার দরজা বন্ধ করতে উদ্যত হয়, ‘ওহ, আচ্ছা।রনি বাসায় নেই।’  ‘নাহ, মানে আনটি আমি আপনার কাছেই এসেছিলাম।’ ‘আমার কাছে কেন?’ মিফতা এইবার একটু সাহস করে বলে, ‘আনটি, একটু ভিতরে আসতে পারি?’ রনির মা মিফতাকে ভেতরে বসতে দেন। তারপর নিজেও বসে বলেন, ‘বল এবার। কেন এসেছ?’ মাথা চুলকাতে চুলকাতে মিফতা বলে, ‘আনটি, রনির বিয়ের ব্যাপারে শুনলাম।’ বাঁকা হাসি দেখা যায় রনির মার মুখে। ‘ওহ, তাহলে তোমাকে সব বলেছে।’ ‘জি, আনটি। ওতো আমাকে বলেছে প্রিয়াঙ্কাকে না পেলে আত্মহত্যা করবে।’ ‘তাহলে, ওকে মরতে দাও।’ রীতিমত লাফ মেরে উঠেন জাহানারা খাতুন। মিফতা তাড়াতাড়ি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। ‘না, আনটি। আপনি তা পারেন না। রনির বাবা যদি একবার রনির অবস্থা একবার দেখে তাহলে কি হবে বলুন তো।’ বাবার কথা বলায় মনে হল একটু কাজ হয়েছে। একটু চিন্তিত দেখায় রনির মাকে। যেমনটা ভেবেছিল মিফতা। বড়লোক বাপের আদরের বড়লোক পোলা। পোলা আকাম-কুকাম করে বেড়াবে বাট নো প্রবলেম। উত্তরাধিকারী বলে কথা। ‘ঠিকই বলেছ তুমি। ওর কিছু হলে ওর বাবা আমাকে……।’ ‘জি, আনটি ওটাই বলছিলাম।’ আবার উৎসাহ ফিরে পায় মিফতা। ‘অতীতের সব ভুলে যান। আমি জানি আপনি পারিবারিক চাপে প্রিয়াঙ্কার বাবাকে বিয়ে করেন নি।’ ‘কে বলেছ তোমাকে!’ আবার লাফিয়ে উঠেন জাহানারা খাতুন। চালে আবারও ভুল করে ফেলেছে মিফতা। ‘ও সবসময় অকর্মার মত ঘুরে বেড়াত। ওকে বিয়ে করলে খেতাম কি?’ শেষ চাল চালে মিফতা। লাগলে লাগল নাহলে সব শেষ। ‘কিন্তু আপনি তো রনির বাবাকেও বিয়ে করে সুখি হতে পারেননি। রনির বাবা সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন আর আপনাকে না জানিয়ে যখন তখন বিদেশে চলে যায়।’ আবার একটু শান্ত হন জাহানারা খাতুন। নরম স্বরে বলেন, ‘হ্যাঁ, তা ঠিক। কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে?’ বিজ্ঞের মত মিফতা মাথা নেড়ে বলে, ‘এতো আনটি হয়েই থাকে। কিছু মনে করবেন না। আপনাদের সময়কার ধনীরা বিয়ে করত শুধু উত্তরাধিকার পাওয়ার আশায়। কিন্তু আমরা এখন আসল প্রসঙ্গে আসি। কেও তো আর জানছে না আপনার আর প্রিয়াঙ্কার বাবার কথা। তাই না?’ ‘হমম, সেটাই। কিন্তু আমি কি করব এখন?’ রীতিমত অসহায় হয়ে পড়েন জাহানারা খাতুন। মিফতাও সহায় দেয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘প্রিয়াঙ্কার বাবার সাথে কথা বলুন। তিনি এখনও আপনাকে ভালবাসেন।’ কি!কি বলছ এসব! তোমাকে এসব কে বলেছে?’ জাহানারা খাতুনের চোখে এইবার উৎকণ্ঠা দেখতে পায় মিফতা। আস্তে করে বলে, ‘প্রিয়াঙ্কা বলেছে। ও আমার বোনের মত। ভেবে দেখুন তো একবার। প্রিয়াঙ্কার বাবার মত মানুষটা জীবনে অন্তত একবার তো ভাল কিছু পেতে তো চাইতে পারে।’ ‘কিন্তু ওর সাথে আমি দেখা করার কথা কিভাবে বলব?’ ‘ওটা আনটি আমার উপর ছেড়ে দেন।’ রনির বাড়িতে মিফতা প্রায় দুই ঘণ্টা কাটায় দেয় মিফতা। জাহানারা খাতুন কিছু না খাইয়ে মিফতাকে ছাড়তে চান না। রাস্তায় এসে আবার সূর্যের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। পাশে থেকে একটা লোক বলে, ‘ভাই,আকাশে কি কিছু হারায় গেছে?’ মিফতা একবার লোকটার দিকে তাকায় তারপর হাঁটা ধরে।
# দরজা খুলতেই মিফতা একটা রঙ্গিন হাসি দেয়ে মিফতা ভেতরে ঢুকে। ‘আঙ্কেল, আমি আনটির সাথে কথা বলেছি।’ হথভম্ব হয়ে সামশুল সাহেব তাকিয়ে থাকেন । ‘সে আপনাকে এখনও ভালোবাসে। জোর দিয়ে বলে মিফতা। ‘কি! কি বলছ, তুমি?’ রীতিমত হকচকিয়ে যান সামশুল সাহেব। ‘হ্যাঁ, আঙ্কেল।’ মিফতার উচ্ছ্বাসের যেন শেষ নেই। ‘আনটি অনেক পারিবারিক চাপেই বিয়েটা করেছিলেন।আমাকে তিনি সব বলেছেন।’ ‘তোমাকে সব বলেছে!’ ‘অবশ্যই।আর তিনি এই বিয়েতে সুখীও হতে পারেননি।’ সামশুল সাহেব বুঝতে পারেননা মিফতা এত কথা জাহানারার মুখ দিয়ে কিভাবে বের করল । শুধু জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন বাবা?’ ‘ওনার স্বামীতো ওনাকে একবারই সময় দেননা। আর বিদেশে যখন যায় তখন কি আর বলব। আল্লাহ!’ সামশুল সাহেব চুপ করে বসে থাকেন। কি যেন ভাবতে থাকেন উনি। দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মিফতাই নিরবতা ভাঙ্গে, ‘আঙ্কেল।’ ‘হা,বাবা?’ ‘আনটির সাথে কথা বলেন।’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই। কোথায় দেখা করা যায় বলত?’ এবার মিফতা ও ওর আসল চাল চালে। ‘টি.এস.এসসি। আনটি ওখানেই দেখা করতে চেয়েছেন। আপনি যাবেন তো?’ এবার সামশুল সাহেব উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েন। ‘অবশ্যই। আমি অবশ্যই যাবো। তুমি তোমার আনটিকে জানাও।’ এবার মিফতাও দাঁড়িয়ে পড়ে। সামশুল সাহেবকে কথা দিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। এবার আর একটা কাজ বাকি।
# আজকে রনির বাড়িতে দারোয়ান আটকায়নি। মিফতা দৌড়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে। কলিংবেল দিতেই দরজা খুলে দেন জাহানারা খাতুন। ভিতরে না ঢুকেই মিফতা বলে, ‘আনটি, আঙ্কেল আগামীকাল আপনার সাথে টি.এস.সিতে দেখা করবেন।’  ‘টি.এস.সি কেন?’ ‘আমি জানিনা ।আঙ্কেল বললেন তাই।’ রনির মা কিছুক্ষণ চিন্তা করেন। তারপর বলেন, ‘ঠিকআছে।’ মিফতাকে অনেক জোর করলেও মিফতা ভেতরে ঢুকেনা। কাজ আছে বলে পালিয়ে যায়। আপাতত রনির সামনা-সামনি হওয়া যাবেনা।
# ‘আচ্ছা,মিফতা করছে কি বলত।ও নাকি আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসছে। আমার সাথে তো একদিনও দেখা হয়নি।’ রনিকে চিন্তিত দেখায়। প্রিয়াঙ্কা আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘ও আমাদের বাবা-মাকে বোঝাচ্ছে।’ ‘তা জানি।কিন্তু মিফতা উনাদের বলছে কি আসলে?’ ‘আমি কি জানি।দাঁড়াও, ওকে কল দিচ্ছি।’ প্রিয়াঙ্কার নাম্বার দেখতেই মিফতা চট করে রিসিভ করে। ‘হ্যালো, প্রিয়াঙ্কা?’ ‘হ্যাঁ, কি খবর।সব কিছু কেমন চলছে?’ ‘খুব ভালো। কালকে টি.এস.সিতে আঙ্কেল আনটি দেখা করবেন। প্রিয়াঙ্কা খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে। ‘ওমা, তাই? ওনারা টি.এস.সিতে দেখা করবেন কালকে?’ রনি লাফিয়ে উঠে প্রিয়াঙ্কার কথা শুনে। ‘মানে! মানে কি এসব। টি.এস.সি কেন? আমাকে দাওতো।’ মিফতা এবার ফোনে রনির গলা শুনতে পায়। ‘মিফতা, তোমার প্লান কি আসলে বলতো।’ মিফতা রনিকে আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘চিন্তা করো না ব্রাদার। আগামীকালকের পর দেখবা তোমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে।’ ‘তুমি নিশ্চিত?’ ‘বিশ্বাস রাখো, ব্রো।’ ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ ফোন রেখে রনি একবার প্রিয়াঙ্কার দিকে একবার তাকায়। রনিকে কেমন যেন চিন্তিত দেখায়।
#সামশুল সাহেব বুঝতে পারছেন যে আশেপাশের সব ছেলেমেয়ে তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। তিনি ব্যাপারটা পাত্তা দিলেন না। একটা সি.এন.জি তার সামনে এসে থামে। জাহানারা খাতুন সি.এন.জির ভাড়া মিটিয়ে সামশুল সাহেবের দিকে তাকাতেই সামশুল সাহেব অন্য এক জগতে হারিয়ে যান। সেদিন জাহানারাকে দেখতেই কেমন যেন একটা রাগ কাজ করেছিলো। আজকে তা করল না। ‘কেমন আছ, অনামিকা?’ সেই পুরন ডাক শুনে জাহানারা খাতুনও একইভাবে উত্তর দেন, ‘ভাল আছি তুমি কেমন আছ, সাগর?’ এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘টি.এস.সি। সেই পুরনো জায়গা।’ কিছুক্ষন দুজনে চুপ করে থাকেন। তারপর প্রিয়াঙ্কার বাবা আবারও বলতে শুরু করেন, ‘আমি জানি, অনামিকা। তুমি শুধু পারিবারিক কারনেই আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে।’ নিস্পলকভাবে জাহানারা খাতুন তাকিয়ে থাকেন। এই মানুষটা এখনও বিশ্বাস করতে পারেনি যে সে তার সাথে প্রতারণা করেছে। ‘জানো, আমার স্বামী আমাকে কখনই শান্তি দেয়নি।’ ‘আমি জানি ,অনামিকা। তোমার স্বামীর সব কীর্তি কলাপ আমি সবই জানি।’ ‘কিভাবে জানলে?’ আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন জাহানারা খাতুন। ‘আমি সব সময়ই তোমার খোঁজ-খবর রাখতাম, অনামিকা।’ ‘ওহ,সত্যি?’ ‘হ্যাঁ, আর জানো আমি প্রিয়াঙ্কার মাকে শুধু বিয়ে করেছিলাম সামাজিক জীবনের জন্য। কিন্তু আমি পরে বুঝতে পেরেছি যে আমি ভুল করেছি। তাই ও মারা যাওয়ার পরে আমি আর বিয়ে করিনি।‘ দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আশেপাশের মানুষজন ভাবে করছে কি এই বুড়া-বুড়ি। এরপর তারা দুইজন চটপটির দোকানে বসেন। হাসাহাসি-গল্প চলতে থাকে।
 #’মিফতা, হচ্ছেটা কি বলতো। আমার বাবা আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে না।’ ‘আমার মাও প্রতিদিন ঘর থেকে বেরোচ্ছে আমার তো মনে হয় প্রতিদিন আনটির সাথে দেখা করছে।’ ‘মিফতা, আমার বাবাকে কেমন যেন লাগছে ইদানীং।’ ‘আরে থামো, আমাকে তো কিছু বলতে দাও। আমি কি জানি তারা কি কথা বলছে। আমি তো আমার কাজ করে ফেলেছি। হয়ত তারা বিয়ের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করছেন। এত হতাশ হলে হবে? সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ‘আমি তো তাই চাই।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়াঙ্কা। রনি চোখে কেমন জানি লাল-নীল তারা দেখতে থাকে।
# ‘মিফতা, এটা কি হল!’ রীতিমত ভেঙ্গে পড়েছেন সামশুল সাহেব। ‘কি হয়েছে, আঙ্কেল?’ ‘আমি আবার জাহানারার প্রেমে পড়েছি।’ ‘সত্যি!’ সব খাপে খাপে মিলে গিয়েছে। মিফতার খুশি আর ধরে না। ‘আপনার তো তাহলে আনটিকে সব বলা উচিত।’ করুণ নয়নে সামশুল সাহেব তাকান। ‘কিন্তু প্রিয়াঙ্কা?’ ‘মিফতা বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে, ‘প্রিয়াঙ্কার কোন ইচ্ছে আপনি পুরন করেন নি? ও যা চেয়েছে তাই পেয়েছে সব সময়। আপনারও তো জীবন একটাই। আর প্রিয়াঙ্কার জন্য আমি তো আছি।’ সামশুল সাহেব অস্থির হয়ে পড়েন। প্রিয়াঙ্কার জন্য মিফতাকেই সব সময় পছন্দ ছিল তার। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। ‘তুমি ঠিক বলেছ ,মিফতা। যা আছে কপালে।’ ‘জি,আঙ্কেল। কপালের  লিখা খন্ডায় কে।’
# ‘মিফতা, আমি এখন কি করব?’ রীতিমত ফোনে মরাকান্না জুড়ে দেন জাহানারা খাতুন। মিফতা সান্ত্বনা দেয়, ‘আনটি, শান্ত হোন। শুধুমাত্র নিজের হৃদয়ের কথা শুনেন।’ ‘সেটা কিভাবে, বাবা?’ ‘পুরনো দিনের মত, আনটি। শুধু এইবার আর ভুল করেন না।’ জাহানারা খাতুনের মাথায় একটা কথাই ঘুরতে থাকে। পুরনো দিন, পুরনো দিন।
 #প্রিয়াঙ্কা ফ্যাল ফ্যাল করে রনির দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘রনি, এটা কিভাবে হল। শেষমেশ আমরা ভাই-বোন।’ রনি কিছু বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। সামনে মিফতা দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে। ‘তুমি এটা প্রিয়াঙ্কাকে পাওয়ার জন্যে করেছ, তাই না?’ মাথা নাড়ে মিফতা। ‘না,আমি শুধু আমার প্রতিশোধ নিলাম। এবার বিদেশী বউ খুঁজব।’ রনি উঠে দাঁড়ায়। ‘আমি তোমাকে ধরতে পারলে খুন করব।’ ‘আগে ধর।’ এই বলেই মিফতা দৌড় দেয়। পিছনে রনিও। প্রিয়াঙ্কা ভাবতে থাকে সব গেল। ও যদি মিফতার সাথে থাকত তাহলে জীবনে কোন বিপদের মোকাবেলা করতে হত না। ও যা চায় তাই করতে পারে।
Share on Google Plus

About Unknown

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
    Blogger Comment

0 comments:

Post a Comment